বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৭ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
বিয়ে অস্বীকার করলে কী করবেন

বিয়ে অস্বীকার করলে কী করবেন

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: সুজন ও সুমি একই সাথে পড়াশুনা করে। উভয়ের মধ্যে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক। প্রেমকে বাস্তবে রুপ দিতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। সুজন একদিন বন্ধুর বাসায় মৌলভি ডেকে সুমিকে মুসলিম ধমর্মতে বিয়ে করেন। এরপর স্বামী-স্ত্রীর মতো দৈহিক সম্পর্ক সহ দাম্পত্য জীবন চলতে থাকে। কথা ছিল পড়াশুনা শেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে উভয় পরিবারকে বিয়ের কথা জানানো হবে। কিন্তু ততদিনে সুজন বদলে গেছেন। ফোন দিলে ধরেন না। দেখা করেন না, কথাও বলেন না। বন্ধুদেরকে বলে বেড়ান, সুমির সঙ্গে নাকি তার বিয়েই হয়নি। এখন স্বামী স্বীকৃতি না দিলে সুমি কীভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে।

বিয়ে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনও কখনও তা অভিশাপ রূপে দেখা দেয়। বিয়ে নিয়ে এরকম প্রতারণার ঘটনা হরহামেশায় ঘটতে দেখা যায়। আবার দেখা যায় দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক কোনো কারণে ভেঙে গেলে কোনো পক্ষ ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে দাবি করতে থাকে। আবার এমনও দেখা যায় আদৌ বিয়ে হয়নি অথচ বিয়ে হয়েছে, এ বলে মিথ্যা প্রমাণ দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো সংসার করতে থাকেন। একটি পর্যায়ে মেয়েটিকে আর ভালো না লাগলে কিংবা মেয়েটি গভর্বতী হয়ে পড়লে ছেলেটি বিয়ে অস্বীকার করতে থাকে। এ ধরনের ঘটনাগুলোই বিয়ে-সংক্রান্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা থেকে ৪৯৮ ধারা পর্যন্ত বিয়ে-সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান প্রণীত হয়েছে, যার অধিকাংশই জামিন-অযোগ্য অপরাধ।

কাবিননামা সম্পন্ন না করে বিয়ে করে পরে তা অস্বীকার করলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দণ্ডবিধির অধীনে ফৌজদারি আদালতেরও আশ্রয় নিতে পারে। দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন, তবে অপরাধী ১০ বছর পযর্ন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- এবং অথদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৪ ধারায় বলা অছে, যদি কোনো ব্যক্তি এক স্বামী বা এক স্ত্রী জীবিত থাকা সত্ত্বেও পুনরায় বিয়ে করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৫ ধারায় বলা অছে, যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় প্রথম বা পূর্ববর্তী বিয়ের তথ্য গোপন রাখেন, তা যদি দ্বিতীয় বিবাহিত ব্যক্তি জানতে পারেন, তাহলে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। তবে জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৬ ধারায় বলা অছে, আইনতঃ বিবাহ নয় জেনেও প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান উদযাপন করা তাহলে অপরাধী সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ।

৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ব্যতীত যৌন করেন এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি র্ধষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ-সহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৮ ধারায় বলা অছে, অপরাধজনক উদ্দেশ্যে বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া বা আটক রাখা হলে অপরাধী ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদ-সহ উভয় ধরণের শাস্তি পাবেন। তবে জামিন যোগ্য ধারার অপরাধ।
যদি কোন খ্রীষ্টান ব্যক্তি নিজেকে হিন্দু হিসাবে পরিচয় দিয়ে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে হিন্দু গোত্রের কোন মেয়েকে বিবাহ করে, পরে প্রকাশ পায় যে, সে হিন্দু নয়। এইসব ক্ষেত্রে উক্ত ধারায় অপরাধ সংঘটিত হবে।

এছাড়া পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করে বিয়ে প্রমাণ করা যায়। একটি কেস ষ্টাডি থেকে জানা যায়, মমতাজ বেগম ও আনোয়ার হোসেন ইসলামী শরিয়ত মতে বিয়ে করে ঘর-সংসার করতে থাকেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বিয়ের কোনো কাবিননামা রেজিস্ট্রি হয়নি। এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের কাছে যৌতুক দাবি করে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মমতাজ বেগম তার ভরণপোষণ এবং দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন। আনোয়ার হোসেন বিয়েকে অস্বীকার করে আদালতে জবাব দাখিল করে করেন। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে পারিবারিক আদালত আদেশ দেয়, তাদের মধ্যে বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। পারিবারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ আনোয়ার হোসেন ১৯৯৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট বিভাগের একটি একক বেঞ্চ ১৯৯৯ সালে পারিবারিক আদালতের আদেশটি খারিজ করে দেন। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো প্রকার কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি যা বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং মমতাজ বেগম তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগের এ রায়ের বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দায়ের করেন এবং আপিল মঞ্জুর হয় তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করে
১. মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্ট্রি না হলে এটি বাতিল, অবৈধ বা অস্তিত্বহীন কি-না;
২. তিন বছর ধরে তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করা এবং বসবাসের শর্ত বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে কি-না;
৩. হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়োগ করে নিম্ন আদালতের আদেশ এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বৈধ বিয়ের অস্তিত্বের বিষয়ে বিবেচনা করেছেন কি-না।

আপিল বিভাগে মমতাজ বেগমের পক্ষে ২০০৩ সালে আপিলটি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়া। সিভিল আপিল নাম্বার-১৩৯/২০০৩। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০১১ তারিখে আপিল বিভাগ মমতাজ বেগমের পক্ষে রায় দেয়। মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেন এবং তাদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গণ্য হতে পারে। সুতরাং কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।

ভারতের কেরালার একটি পারিবারিক আদালতে এক নারী ভরণ পোষণের দাবিতে মামলা করেন যেখানে বাদীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত পন্থায় এক ছাদের নিচে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করছিলেন তিনি। বিয়ে সম্পর্কিত কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকায় নিম্ন আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। কিন্তু কেরালা হাইকোর্টে বিচারপতি সি এস কারনান এ সিদ্ধান্তকে নাকচ করে বিবাহের সংজ্ঞায় যুগান্তকারী ও যুগোপযোগী এক সিদ্ধান্ত দেন। বলা হয়, আইনে সংজ্ঞায়িত প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি বিবাহপূর্ব কোনো শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয় এবং একত্রে বসবাস করে সে ক্ষেত্রে এটিকে ‘বিবাহ’ হিসেবে ধরা হবে এবং একত্রে বসবাসকারী ছেলে-মেয়েদের ‘স্বামী-স্ত্রী’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

আদালত তার রায়ে আরো বলেন, যখন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েরা এভাবে একে অপরের সঙ্গে বসবাস করবে তখন তাদের উভয়ে বা কোনো একজন ওই বসবাসকে ‘বিয়ে’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ‘ঘোষণামূলক মোকদ্দমা’ দায়ের করতে পারবে এবং সে অনুযায়ী সরকারি সব রেজিস্ট্রারে তাদের নাম স্বামী-স্ত্রী গণ্য করতে হবে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সব অধিকার ও দায়দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel